রাশিয়া থেকে সস্তা দরে খনিজ তেল কিনে এত দিন তা পরিশোধনের পর ইউরোপের বাজারে বিক্রি করছিল গুজরাতের সংস্থা ‘নায়রা এনার্জি’। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের উপরে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেওয়ায় এ বার সংশ্লিষ্ট সংস্থাটি চিনে বিপুল পরিমাণে ডিজ়েল রফতানি শুরু করেছে।
নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও আমেরিকার মুখে ঝামা! পরিশোধিত রুশ খনিজ তেল এ বার চিনকে বিক্রি করা শুরু করল কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। সেই খবর প্রকাশ্যে আসতেই দুনিয়া জুড়ে পড়ে গিয়েছে শোরগোল। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের দাবি, এর মাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে মুখের মতো জবাব দিয়েছে নয়াদিল্লি। দ্বিতীয়ত, আমেরিকার রক্তচাপ বাড়িয়ে ধীরে ধীরে কাছাকাছি আসছে তিন মহাশক্তি— ভারত, চিন ও রাশিয়া।
সংবাদসংস্থা ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্প্রতি ড্রাগনভূমিতে বিপুল পরিমাণে ডিজ়েল পাঠিয়েছে গুজরাতের খনিজ তেল পরিশোধন সংস্থা ‘নায়রা এনার্জি’। চলতি বছরের জুলাইয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাটির উপরে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ। মস্কোর ‘তরল সোনা’ উরাল ক্রুড পরিশোধন করে ইউরোপীয় সংগঠনটির ২৭টি দেশকে বিক্রি করছিল তারা। সেই কারণে নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয়েছে বলে স্পষ্ট করে ইইউ।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ‘নায়রা’র থেকে পরিশোধিত পেট্রোপণ্য কেনা বন্ধ করতেই বিকল্প বাজারের খোঁজে কোমর বেঁধে লেগে পড়ে কেন্দ্রের মোদী সরকার। অন্য দিকে ইইউয়ের পদক্ষেপকে ‘একতরফা এবং প্রতিহিংসামূলক’ বলে কড়া সমালোচনা করেছিল গুজরাতের ওই পরিশোধন সংস্থা। শুধু তা-ই নয়, এই ইস্যুতে আইনি পদক্ষেপের হুঁশিয়ারিও দেয় তারা। তবে মাত্র এক মাসের মধ্যেই চিনের মতো বিশাল বড় একটি বিকল্প বাজারের হদিস যে ‘নায়রা এনার্জি’ পাবে, তা স্বপ্নেও ভাবেনি ২৭ দেশের ওই ইউরোপীয় সংগঠন।
মালবাহী জাহাজের অবস্থান নির্ণায়ক সংস্থা ‘কেপলার’কে উদ্ধৃত করে ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, গত ১৮ জুলাই নায়রার টার্মিনাল থেকে চিনের দিকে রওনা হয় ‘ইএম জ়েনিথ’। সংশ্লিষ্ট জলযানটিতে রয়েছে প্রায় ৪ লক্ষ ৯৬ হাজার ব্যারেল অতি নিম্ন সালফার ডিজ়েল। প্রথমে দক্ষিণ দিকে গিয়ে তার পর পূর্বের মলাক্কা প্রণালী সংলগ্ন মালয়েশিয়ার একটি বন্দরে প্রায় ১২ দিন নোঙর করেছিল ওই জাহাজ। জ়েনিথের গন্তব্য চিনের ঝোশান বলে জানিয়েছে ওই জনপ্রিয় মার্কিন গণমাধ্যম।
২০২১ সালের এপ্রিলের পর আর কখনওই চিনকে কোনও জ্বালানি সরবরাহ করেনি ভারত। চার বছর পর গুজরাতের সংস্থাটির বেজিংকে ডিজ়েল পাঠানো তাই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন কূটনীতিকদের একাংশ। ‘নায়রা এনার্জি’তে আবার রুশ সংস্থা রসনেফ্টের ৪৯.১৩ শতাংশ অংশীদারি রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা চাপানোর নেপথ্যে একে সবচেয়ে বড় কারণ বলে জানিয়েছিল ইইউ।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার পর ‘নায়রা এনার্জি’র সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় আন্তর্জাতিক লেনদেন। ফলে বাধ্য হয়ে গুজরাতের পরিশোধন সংস্থাটি উৎপাদন বেশ কিছুটা কমিয়ে দিয়েছিল। পরে আগাম টাকা, ঋণপত্র বা বন্ডের বিনিময়ে বিদেশে পেট্রোপণ্য সরবরাহের সিদ্ধান্ত নেয় ‘নায়রা এনার্জি’। সূত্রের খবর, চিনের ক্ষেত্রেও সেই নিয়মের কোনও ব্যতিক্রম হয়নি।
জুলাইয়ের শেষে ভারতীয় পণ্যে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ফলে নয়াদিল্লির উপরে আমেরিকার মোট শুল্কের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশ। ওয়াশিংটনের ওই ঘোষণার পর ‘নায়রা এনার্জি’র আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের থেকে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন সাময়িক ভাবে স্থগিত করে দেশের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক এসবিআই (স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া)।
গত জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট হিসাবে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন ট্রাম্প। এর জন্য ফোনে একাধিক বার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। কিন্তু, তাতে কাজের কাজ হয়নি। শেষে বিরক্ত হয়ে গত ১৪ জুলাই আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় শক্তিজোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটোর (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) মহাসচিব মার্ক রাটের সঙ্গে বৈঠক করেন ট্রাম্প।
![]() |
ওই বৈঠকের পরই খোলাখুলি ভাবে ভারত, চিন এবং ব্রাজ়িলকে রাষ্ট্রপ্রধানের নাম করে হুমকি দেন রাট। বলেন, ‘‘নিষেধ সত্ত্বেও রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে গেলে, মস্কোর থেকে তেল ও গ্যাস কিনতে থাকলে, কঠোর আর্থিক শাস্তির মুখে পড়তে হবে। ক্রেমলিন যদি শান্তি আলোচনাকে গুরুত্ব সহকারে না নেয়, তা হলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলির উপরেও ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করব আমরা।’’
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, রাটের ওই হুমকির পরেই গুজরাতের ‘নায়রা এনার্জি’র উপরে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে বিশেষ সেনা অভিযান (স্পেশ্যাল মিলিটারি অপারেশন) চালাচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি কিভ আক্রমণের নির্দেশ দিতেই আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়া মস্কোর উপরে চাপিয়ে দেয় ১৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা। এর মাধ্যমে আর্থিক ভাবে ক্রেমলিনকে পুরোপুরি পঙ্গু করতে চেয়েছিল তারা।
কিন্তু, যুদ্ধের মধ্যে অর্থনীতিকে বাঁচাতে ‘দাবার চালে’ সম্পূর্ণ পরিস্থিতি উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। ভারতকে সস্তা দরে খনিজ তেল বিক্রির ‘মেগা অফার’ দেয় তাঁর সরকার। সঙ্গে সঙ্গে মস্কোর থেকে বিপুল পরিমাণে উরাল ক্রুড আমদানি করা শুরু করে নয়াদিল্লি। আর্থিক দিক থেকে এতে আখেরে লাভবান হয় কেন্দ্র। আন্তর্জাতিক বাজারে ‘তরল সোনা’র দাম ঠিক রাখতে এর পর ক্রেমলিনের তেল পরিশোধন করে পেট্রোপণ্য ইউরোপের বাজারে বিক্রি করতে থাকে একাধিক ভারতীয় সংস্থা।
গত সাড়ে তিন বছরে ইউরোপের বাজারে পরিশোধিত রুশ তেলের অন্যতম বড় রফতানিকারী সংস্থা ছিল গুজরাতের ‘নায়রা এনার্জি’। কিন্তু, রাটের সঙ্গে বৈঠকে এই ব্যবসা আটকাতে তৎপর হন ট্রাম্প। আমেরিকা ও পশ্চিমি দুনিয়ার দাবি, এ ভাবে সস্তা দরে ক্রমাগত মস্কোর থেকে নয়াদিল্লি ‘তরল সোনা’ কিনতে থাকায় যুদ্ধ চালানোর প্রয়োজনীয় অর্থ পেয়ে যাচ্ছে ক্রেমলিন। ফলে ইউক্রেনে শান্তি ফেরানো সম্ভব হচ্ছে না।
রাশিয়ার সস্তা দরের খনিজ তেল কেনার ক্ষেত্রে ভারতের পাশাপাশি পিছিয়ে নেই চিনও। বর্তমানে মস্কোর ‘তরল সোনা’ সর্বাধিক আমদানি করছে বেজিং। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে নয়াদিল্লি। জুলাইয়ে রাটের সঙ্গে বৈঠকের পর ট্রাম্প হুমকি দিয়ে বলেন, ‘‘৫০ দিনের মধ্যে ক্রেমলিনকে শান্তি সমঝোতায় আসতে হবে। নইলে রাশিয়ার বাণিজ্যিক বন্ধুদের উপরে ১০০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেব আমরা।’’
মার্কিন প্রেসিডেন্টের ওই হুঁশিয়ারিতে দমে গিয়ে রুশ তেল আমদানি হ্রাস করেনি ভারত। এর পরই অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপান তিনি। এ-হেন পরিস্থিতিতে আগামী ১৫ অগস্ট ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় পুতিনের সঙ্গে মুখোমুখি বৈঠকে বসছেন ট্রাম্প। তাঁর দাবি, ভারতের উপরে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের জেরেই আলোচনার টেবলে বসতে রাজি হচ্ছে রাশিয়া।
অন্য দিকে বৈঠকের আগে মস্কো জানিয়ে দিয়েছে যে, সংশ্লিষ্ট বৈঠকে তাদের যাবতীয় দাবি মানতে হবে। সেখানে কোনও রকমের সমঝোতা করবেন না প্রেসিডেন্ট পুতিন। ইউক্রেন প্রেসিডেন্টে জ়েলেনস্কি আবার বলেছেন, আলাস্কার বৈঠকে দেশভাগের সিদ্ধান্ত হলে কিছুতেই মানবেন না তিনি। সে ক্ষেত্রে পশ্চিম ইউরোপের ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানির সমর্থন কিভের দিকে থাকবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
কূটনীতিকদের কথায়, আলাস্কার বৈঠকের আগে রুশ অংশীদারিতে চলা ভারতীয় সংস্থার চিনে ডিজ়েল বিক্রির আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। ইউক্রেন নিয়ে সেখানে কোনও সমাধান সূত্র বার না হলে চিন এবং ভারতের উপরে নিষেধাজ্ঞা ও শুল্কের অঙ্ক বৃদ্ধি করতে পারেন ট্রাম্প। সে কথা মাথায় রেখেই এখন থেকে নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক মজবুত করছে বেজিং এবং নয়াদিল্লি। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, পর্দার আড়ালে থেকে গোটা বিষয়টির কলকাঠি নাড়ছে মস্কো।
২০২০ সালে পূর্ব লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বা এলওসির (লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল) গালওয়ান উপত্যকায় চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ-র সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় ভারতীয় সেনা। ওই সংঘাতে প্রাণ হারান কর্নেল বি সন্তোষ বাবু-সহ ২০ জন সৈনিক। সূত্রের খবর, ৪০ জন ফৌজিকে হারায় বেজিং। গালওয়ানের লড়াইয়ের পর দুই দেশের সম্পর্ক চলে যায় তলানিতে। ফলে নয়াদিল্লিকে ইউরিয়া-সহ একাধিক সার রফতানি বন্ধ করে দেয় ড্রাগন সরকার।
ব্লুমবার্গের রিপোর্ট অনুযায়ী, এ বছরের জুন থেকে সেই নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নিয়েছে বেজিং। ফলে চলতি আর্থিক বছরে তিন লক্ষ টন ইউরিয়া বেজিং থেকে এ দেশের কৃষকেরা আমদানি করতে পারবেন বলে জানা গিয়েছে। নয়াদিল্লিকে সংশ্লিষ্ট সারটি বিক্রির ক্ষেত্রে ড্রাগনভূমির সংস্থাগুলি দাম কমাতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে। চিনকে বাদ দিলে রাশিয়ার থেকেও বিপুল পরিমাণে সার ও কৃষিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক কিনছে ভারত।
এ বছরের ৩১ অগস্ট ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’ বা এসসিও-র (সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজ়েশন) বৈঠকে যোগ দিতে চিনের তিয়ানজ়িন সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। সেখানে ড্রাগন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের সঙ্গে আলাদা করে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে তার। সেপ্টেম্বরে ভারত সফরে আসতে পারেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। আগামী ১৮ অগস্ট নয়াদিল্লিতে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বা এনএসএ (ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসার) অজ়িত ডোভালের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন বেজ়িঙের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই। সেখানে সীমান্ত সংঘাত মিটিয়ে ফেলার ব্যাপারে আলোচনা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের অনুমান, ট্রাম্পের সঙ্গে ইউক্রেন নিয়ে আলোচনায় বসার আগে যাবতীয় তাস সাজিয়ে নিতে চাইছেন পুতিন। চিন ও ভারতকে সঙ্গে নিয়ে একটা ত্রিমুখী জোট তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। অন্য দিকে, মার্কিন শুল্কনীতির প্রতিবাদ জানিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নয়াদিল্লির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে ব্রাজ়িলও। আলাস্কার বৈঠকের পর পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় সেটাই এখন দেখার।