দফায় দফায় ইসলামাবাদের উপর চাপ বৃদ্ধির চেষ্টায় দিল্লি! পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ডের পর ১১ দিনে ১২টি ‘অবরোধ’
গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে হামলা চালায় জঙ্গিরা। ভারতের অভিযোগ, ওই হামলায় সীমান্তপারের যোগ রয়েছে। পাকিস্তান যদিও তা অস্বীকার করেছে। ওই ঘটনার পরের দিন থেকে দফায় দফায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ কূটনৈতিক পদক্ষেপ করেছে ভারত।
গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীর উপত্যকায় জঙ্গিদের গুলিতে ২৬ জনের মৃত্যু হয়। তাঁদের মধ্যে ২৫ জনই ছিলেন পর্যটক। ভারতের সন্দেহ, ওই হামলায় সীমান্তপারের যোগ রয়েছে। যদিও সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে পাকিস্তান। পহেলগাঁওয়ে ওই হত্যাকাণ্ডের সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ছিলেন সৌদি আরব সফরে। জঙ্গিদের হত্যালীলার খবর পেয়ে বিদেশ সফর কাটছাঁট করে ২৩ এপ্রিল সকালেই নয়াদিল্লি ফিরে আসেন মোদী। দেশে ফেরার পরেই দফায় দফায় বৈঠকে বসেন তিনি। আলোচনা করেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা সংক্রান্ত কমিটিরও একটি বৈঠক হয়। তার পরই বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রী সাংবাদিক বৈঠকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম প্রত্যাঘাত ঘোষণা করেন।
সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত
আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় টানা ন’বছরের আলোচনার পরে ১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু জলবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে, তবে এই জলচুক্তিতে তার ‘কোপ’ পড়েনি। গত ২৩ এপ্রিল মিস্রী জানিয়ে দেন, সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। এই জলচুক্তির মাধ্যমে সিন্ধু এবং তার উপনদীগুলির জলের উপর কোন দেশের কতটা অধিকার থাকবে, তা নিয়ন্ত্রিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী, সিন্ধু এবং তার দুই উপনদী, বিতস্তা (ঝিলম) ও চন্দ্রভাগার (চেনাব) জলের উপরে পাকিস্তানের অধিকার ও কর্তৃত্ব থাকার কথা। ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা সিন্ধুর তিন উপনদী— বিপাশা (বিয়াস), শতদ্রু (সাটলেজ়) এবং ইরাবতী (রাভি)-র জল। ভারত সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত রাখার পরেই পাকিস্তানের তরফে পাল্টা হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। তারাও জানিয়ে দেয়, জলপ্রবাহে বাধা দেওয়া হলে তা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ হিসাবে দেখা হবে।
পাকিস্তানি পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ
পাকিস্তানে তৈরি কোনও পণ্য সরাসরি বা ঘুরপথে আমদানি নিষিদ্ধ করেছে ভারত। কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জানিয়েছে, জাতীয় নিরাপত্তা এবং সরকারি নীতির স্বার্থে এই নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশিকা জারি না-হওয়া পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকবে। এই নির্দেশিকার কোনও ব্যতিক্রমের জন্য অবশ্যই ভারত সরকারের আগাম অনুমতি নিতে হবে। যদিও ২০১৯ সালে পুলওয়ামায় জঙ্গিহানার পর থেকে পাকিস্তানি পণ্য আমদানি একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। বস্তুত, পাকিস্তান সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তৃতীয় দেশের মাধ্যমেও কোনও বাণিজ্য হবে না বলে জানিয়েছিল তারা।
ভারতের বন্দরে পাকিস্তানি জাহাজের প্রবেশাধিকার বন্ধ
পাকিস্তানের পতাকা থাকা কোনও পণ্যবাহী জাহাজ ভারতের কোনও বন্দরে প্রবেশ করতে পারবে না। ‘ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ শিপিং’-এর তরফে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে। পাশাপাশি ভারতীয় জাহাজও পাকিস্তানের কোনও বন্দরে যাবে না বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। এই কড়াকড়িতে কোথাও ছাড় দেওয়া হবে কি না, তা ক্ষেত্রবিশেষে বিবেচনা করা হবে।
অটারী সীমান্ত বন্ধ
ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে একমাত্র স্থলবন্দর হল পঞ্জাবের অটারী সীমান্ত। দু’দেশের মধ্যে স্থলপথে যাতায়াতের একমাত্র বৈধ সীমান্তপথ এটি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অটারী সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে ভারত। পহেলগাঁও কাণ্ডের পরের দিনই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অনুরূপ ভাবে পাকিস্তানও পাল্টা অপর প্রান্তে ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারত-পাক উত্তেজনার মাঝে দু’দেশের মধ্যে একমাত্র বৈধ সীমান্তপথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অটারী সীমান্তে আরও একটি আকর্ষণ ছিল ‘বিটিং রিট্রিট’। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ‘বিটিং রিট্রিট’ অনুষ্ঠানেও বদল এনেছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। এই অনুষ্ঠানের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে আর করমর্দন করা হবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসএফ। পাশাপাশি ‘বিটিং রিট্রিট’-এর সময় সীমান্ত ফটকও বন্ধ রাখা হচ্ছে।
ভিসা বাতিল
পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে ভারত। যাঁরা আগে থেকেই ভিসা নিয়ে এ দেশে ছিলেন, তাঁদেরও পাকিস্তানে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র দীর্ঘমেয়াদি ভিসা এবং কূটনৈতিক ভিসার ক্ষেত্রে এই কড়াকড়ি থাকছে না। সাধারণ ভিসায় যাঁরা ভারতে এসেছিলেন, তাঁদের ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত ভারত ছাড়ার সময় দেওয়া হয়েছিল। মেডিক্যাল ভিসায় আসা পাকিস্তানিদের জন্য আরও দু’দিন অতিরিক্ত সময় দেওয়া হয়েছিল। সেই মেয়াদ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাকিস্তানিদের খোঁজ শুরু হয়েছে। কেউ অবৈধ নথিতে এখনও এ দেশে রয়ে গিয়েছেন কি না, তা খুঁজে বার করা হচ্ছে। নয়াদিল্লির সিদ্ধান্তের পরে ইসলামাবাদও একই ভাবে ভারতীয় নাগরিকদের ভিসা বাতিল করে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে শুধু শিখ পুণ্যার্থীদের ভিসায় ছাড় দিয়েছে পাকিস্তান।
পাক দূতাবাসে সামরিক উপদেষ্টাদের ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা
ভারতে পাকিস্তানি দূতাবাসে যে সামরিক আধিকারিকেরা ছিলেন, তাঁদের এ দেশে ‘অবাঞ্ছিত’ বলে ঘোষণা করে নয়াদিল্লি। ওই সামরিক আধিকারিকদের ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। পাকিস্তানও সে দেশে ভারতীয় দূতাবাসে নিযুক্ত ভারতীয় প্রতিরক্ষা, নৌ ও বিমান উপদেষ্টাকে ‘অবাঞ্ছিত’ বলে ঘোষণা করে। তাঁদেরও পাকিস্তান ছাড়ার নির্দেশ দেয়।
পাক দূতাবাসে কর্মীসংখ্যা কমানো
পহেলগাঁও কাণ্ডের পরের দিন সাংবাদিক বৈঠকে ভারতের বিদেশসচিব মিস্রী জানান, নয়াদিল্লিতে পাকিস্তানি হাই কমিশনে আধিকারিকের সংখ্যা ৫৫ থেকে ৩০-এ নামিয়ে আনতে বলা হয়েছে। একই রকম ভাবে ভারতও পাকিস্তানে নিজেদের হাই কমিশনে আধিকারিকের সংখ্যা কমিয়ে আনবে বলে জানান মিস্রী। পরের দিনই পাকিস্তান আলাদা ভাবে ঘোষণা করে, সে দেশে ভারতীয় দূতাবাসে আধিকারিকের সংখ্যা কমিয়ে ৩০-এ নামিয়ে আনতে বলা হয়েছে।
পাকিস্তানি বিমানের জন্য আকাশসীমা বন্ধ
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি বিমানের জন্য আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে ভারত। গত বুধবার রাতে নয়াদিল্লির তরফে এই ঘোষণা করা হয়েছে। কেন্দ্রের তরফে একটি ‘নোটিস টু এয়ার মিশন’ (এনওটিএএম) জারি করা হয়। তাতে বলা হয়, “পাকিস্তানে নথিভুক্ত বিমান বা পাকিস্তান দ্বারা পরিচালিত বিমান ভারতের আকাশসীমা ব্যবহার করতে পারবে না। সামরিক বিমানের ক্ষেত্রেও এই নির্দেশিকা প্রযোজ্য হবে।” বস্তুত, গত ২৪ এপ্রিল পাকিস্তানও একই ধরনের ঘোষণা করেছিল ভারতীয় উড়ান সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে। ভারতীয় উড়ান সংস্থাগুলির জন্য পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধ হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে এই পাল্টা আঘাত হানে ভারত।
নিষিদ্ধ বিভিন্ন পাকিস্তানি ইউটিউব চ্যানেল
পহেলগাঁও কাণ্ডের পরে বেশ কিছু পাকিস্তানি ইউটিউব চ্যানেল এ দেশে ‘ব্লক’ করে দিয়েছে ভারত। এই তালিকায় রয়েছে পাকিস্তানের প্রথম সারির কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের ইউটিউব চ্যানেলও। সরকারের একটি সূত্র মারফত জানা গিয়েছে, নিষিদ্ধ হওয়া পাক ইউটিউব চ্যানেলগুলিতে পহেলগাঁও কাণ্ডের পর ভারতের বিরুদ্ধে প্ররোচনামূলক এবং সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বিষয়বস্তু প্রচার করা হচ্ছিল। এমনকি মিথ্যা ভাষ্য তৈরি এবং ভারতের সেনাবাহিনী সম্পর্কেও বিরূপ মন্তব্য করার অভিযোগ উঠেছে ওই চ্যানেলগুলির বিরুদ্ধে।
পাকিস্তানি বিশিষ্টদের সমাজমাধ্যম ‘ব্লক’
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফের ইউটিউব চ্যানেল ‘ব্লক’ করে দেওয়া হয়েছে ভারতে। কোপ পড়েছে পাকিস্তানের প্রাক্তন ক্রিকেটার শোয়েব আখতারের ইউটিউব চ্যানেলের উপরও। এ ছাড়া পাকিস্তানি ক্রিকেটার বাবর আজ়ম, শাহিন আফ্রিদি, মহম্মদ রিজ়ওয়ান এবং হ্যারিস রউফের ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডলও ভারতে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ভারতে বন্ধ হয়েছে পাকিস্তানি জ্যাভলিন খেলোয়াড় আর্শাদ নাদিমের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট।
পাকিস্তান থেকে পাঠানো চিঠি বা পার্সেল নেবে না ভারত
পাকিস্তান থেকে ডাকযোগে আর কোনও চিঠি বা পার্সেল ভারতে পাঠানো যাবে না। শনিবার ভারতীয় যোগাযোগ মন্ত্রক থেকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে এ কথা জানানো হয়েছে। বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, আকাশপথে বা স্থলপথে পাকিস্তান থেকে সব ধরনের চিঠি এবং পার্সেলের এ দেশে ঢুকতে দেওয়া স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানকে নিশানা
সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জের এক আলোচনাসভায় সন্ত্রাসবাদে মদত দেওয়ার অভিযোগে পাকিস্তানকে বিঁধেছে ভারত। পাকিস্তানকে ‘অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য’ (রোগ স্টেট) বলেও সমালোচনা করেছে দিল্লি। বক্তৃতার একটি পর্যায়ে পাকিস্তানি প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজা আসিফের সাম্প্রতিক একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারের কথাও উল্লেখ করেন ভারতীয় দূত। পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ওই মন্তব্যের কথা উল্লেখ করে পটেল জানান, জঙ্গিগোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন করার পাকিস্তানের ইতিহাস সম্পর্কে সেটি একটি ‘খোলা স্বীকারোক্তি’। তিনি বলেন, “পাকিস্তান যে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসে ইন্ধন জোগাচ্ছে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করছে, তা বেআব্রু হয়ে গিয়েছে। এটি পাকিস্তানকে অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য হিসেবে তুলে ধরেছে।”
আরও পড়ুন :>