Live

বিহারে ভোটার তালিকায় বিশেষ সংশোধন: কুড়ি বছরের ঘুম ভেঙে দেদার লাফাচ্ছে সংখ্যা

 বিহারে ভোটার তালিকায় বিশেষ সংশোধন: কুড়ি বছরের ঘুম ভেঙে দেদার লাফাচ্ছে সংখ্যা

‘নিখোঁজ’ মানে কি একেবারেই নিখোঁজ? স্থায়ী ভাবে স্থানান্তরিত বলে চিহ্নিত হচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের সকলেই কি চিরতরে ঘর ছেড়েছেন?

পটনায় জাতীয় ছাত্র সংগঠনের (এনএসইউআই) বিক্ষোভে পুলিশের জলকামান। বৃহস্পতিবার। ছবি: পিটিআই


এক মহল্লায় ১৫টা ঘর তালাবন্দি পাওয়া গিয়েছে। সেই ঘরের বাসিন্দারা তবে ‘নিখোঁজ’ তালিকাভুক্ত হতে চলেছেন। নির্বাচন কমিশনের বার্তা এসেছে বুথ লেভেল এজেন্টদের (বিএলএ) কাছে। এলাকায় গিয়ে বিধায়ক রামবলী সিংহ যাদবের তৎপরতায় প্রথম বারেই ৯ ঘরের লোকজনের হদিস পাওয়া গেল। তাঁরাই জানালেন, কাজের জন্য চারটি পরিবার বাইরে আছে। বিধায়কের প্রশ্ন, ‘‘বিএলও (বুথ লেভেল অফিসার) কি আদৌ নিজে দেখে কমিশনকে রিপোর্ট দিয়েছিলেন? না কি হাওয়ায় কথা ভাসানো হয়েছে!’’

এই রকম বহু প্রশ্নই বিহারে এখন হাওয়ায় ভাসছে। ‘নিখোঁজ’ মানে কি একেবারেই নিখোঁজ? স্থায়ী ভাবে স্থানান্তরিত বলে চিহ্নিত হচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের সকলেই কি চিরতরে ঘর ছেড়েছেন? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, আগাম কোনও প্রস্তুতির সময় না দিয়ে এক মাসের মধ্যে ফর্ম বা গণনাপত্র জমা করতে বললে কমিশনের ফরমানমাফিক কাগজপত্র জোগাড় করা কি আম আদমির পক্ষে সম্ভব? বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) প্রক্রিয়ার হালচাল সরেজমিনে দেখতে বেরোলে এ সব প্রশ্নের উত্তর মেলা ভার!

নানা প্রশ্নের মায়াজালের মধ্যে সংখ্যার ভোজবাজি আবার বেড়েই চলেছে! এসআইআর-এর প্রথম পর্ব সমাপ্ত হচ্ছে শুক্রবার। নির্বাচন কমিশনের বুধবারের দেওয়া হিসাবে বিহারে মৃত ভোটার মিলেছিল ২০ লক্ষ। সেই সংখ্যা বৃহস্পতিবার দাঁড়িয়েছে ২১ লক্ষ ৬০ হাজার। অর্থাৎ এক দিনে মৃত বেড়েছে দেড় লক্ষের বেশি! স্থায়ী ভাবে স্থানান্তরিত ভোটারের সংখ্যা আগের দিনের ২৮ লক্ষ থেকে বেড়ে ৩১.৫ লক্ষ। রাত পোহালে যখন যবনিকা নামবে, তখন কোন সংখ্যা কত দাঁড়াবে কে-ই বা জানে! কমিশন সূত্রের বক্তব্য, যেমন যেমন ফর্ম আপলোড হচ্ছে, সেই মতোই সংখ্যা বদলাচ্ছে। এই প্রক্রিয়া চলাকালীন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলায় কর্মীদের উপরে কমিশনের নিষেধাজ্ঞা আছে। একান্তে এক বিএলও হাসি মুখে বললেন, ‘‘তারিখ ফুরিয়ে এলে মানুষ বেশি জাগরুক (সচেতন) হয়ে ওঠে, জানেন তো!’’

কে কত ‘জাগরুক’, তার নানা পরীক্ষা একসঙ্গে চলছে। জেলায় জেলায় কমিশনের প্রচার-ভ্যান ঘুরছে ‘জাগরুকতা’র বার্তা নিয়ে। প্রতি বছর ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ এমনিতেই হয়, প্রক্রিয়া চলে তিন মাস ধরে। অন্যান্য রাজ্যের মতো বিহারেও শেষ ভোটার তালিকা বেরিয়েছিল চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে। তার পরে ৬ মাসের মধ্যে ২১ লক্ষ ৬০ হাজার মৃত ভোটার বেরিয়ে এল? কমিশন কি আগে তালিকা সংশোধনের সময়ে ‘জাগরুক’ ছিল না? কমিশনের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘সেই ২০০৩ সালের পরে আবার বিশেষ সংশোধন হচ্ছে। কুড়ি বছর পরে, কিছু তো বিশেষ হবেই! আর ওই মৃত এবং স্থানান্তরিতদের তালিকা রাজনৈতিক দলগুলোকে দেওয়া হয়েছে, ভুল থাকলে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য।’’

যারা যেমন জেগে আছে, তারা তেমন খবর পাচ্ছে। ঘোসির সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের বিধায়ক রামবলী দ্রুত খবর পেয়ে হস্তক্ষেপ করতে পেরেছেন জেহনাবাদের ওই এলাকায় তাঁদের সংগঠন সক্রিয় বলে। ভোজপুরের আগিয়াঁও কেন্দ্রের আর এক লিবারেশন বিধায়ক শিবপ্রকাশ রঞ্জন মারফত যেমন জানা যাচ্ছে কবিতা দেবীর কথা। বিহারের অন্ত্যেবাসী এক সম্প্রদায়ের ওই মহিলার ভোটার পরিচয়পত্র এবং রেশন কার্ড আছে। জমি নেই, পুঁথিগত কোনও বিদ্যে নেই। কবিতার দাবি, তাঁদের কাছে গণনাপত্র এসেছে। কিন্তু পূরণ করিয়ে কেউ জমা নিতে আসেনি। সরকারি কোনও সংস্থার পরিচয়পত্র বা পেনশনের কাগজ, পাসপোর্ট, ব্যাঙ্ক বা ডাকঘর থেকে শুরু করে স্থানীয় কোনও প্রশাসনের দেওয়া পরিচয়পত্র (১৯৮৭ সালের আগেকার), জন্মের শংসাপত্র, ম্যাট্রিকুলেশন শংসাপত্র, স্থায়ী নিবাসীর শংসাপত্র, বন অধিকার প্রমাণপত্র, তফসিলি বা ওবিসি শংসাপত্র, নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) বা পরিবারপঞ্জি থাকলে তার নথি, ভূমি বা সরকারি আবাসনের নথি— এ সব এঁদের কাছে বহু দূরের কল্পনা!

রাজ্যের বিরোধী দলনেতা, আরজেডি-র তেজস্বী যাদবের মতে, ‘‘গরিব মানুষের পক্ষে এ সব কাগজপত্র আনা সম্ভব?’’ কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতা অজয় চৌধুরীর দাবি, ‘‘শুধু গরিব কেন, অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। শেষমেশ এই সব উটকো কাগজের চাহিদা বাতিল করতে হবে!’’

কমিশনের সর্বশেষ তথ্যেও সমস্যার ‘মান্যতা’ মিলছে। আবেদনপত্র পেয়েও জমা দেননি, এমন ভোটারের সংখ্যা বুধবার ছিল ১৫ লক্ষ। এক দিন পরে সেটা নেমে এসেছে ৭ লক্ষে। তথ্যেই ইঙ্গিত, তারিখ ফুরোনোর মুখে ‘জাগরুকতা’ বেড়েছে। যোগাযোগ করা যায়নি, এমন ভোটারের সংখ্যা এক লক্ষেই দাঁড়িয়ে। তবে কমিশন যোগ করেছে, এই সংখ্যা বিএলও/ বিএলএ-দের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী। এবং কমিশন জানিয়েছে, আগামী ১ অগস্ট খসড়া ভোটার তালিকা বেরোনোর পরে এক মাস সময় থাকবে আপত্তি বা আবেদন করার। কিন্তু বিতর্ক তাতে থামবে?

Previous Post Next Post