কার ভুলে জন্ম নিল PoK? নেহরুর একটা ভুলে আজও মাশুল গুনছে ভারত?
ভারত ও পাকিস্তান ১৯৪৭ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত অন্তত ৫ বার যুদ্ধে জড়িয়েছে। কেন বারবার কাশ্মীরে নজর পাকিস্তানের? কার ভুল? কে ঠিক? জানতে হলে ফিরে দেখতে হবে কাশ্মীরের জন্মলগ্ন। ফিরে যেতে হবে ১৯৪৭-এ।
ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার আগেই কোনও কোনও রাজ্য ভারতের সঙ্গে জুড়তে চায়, আবার কেউ পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে চান। বিকানেরের মহারাজা, সর্দার সিং, সবার আগে ভারতের সঙ্গে জুড়তে রাজি হন। কারণ, তিনি টের পান তাঁর রাজ্যের পড়শি পাকিস্তানের সঙ্গে থাকার চেয়ে ভারতের সঙ্গে থাকলে দীর্ঘমেয়াদী লাভ বেশি। স্বাধীন ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী ভারতের ‘লৌহপুরুষ’ সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল তাঁর সচিব ভিপি মেননকে সঙ্গে নিয়ে এই প্রিন্সলি স্টেটগুলোকে এক ছাতার নিচে আনার মতো অসাধ্য সাধন করেন। সে সময় তিনি পেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও শেষ ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের প্রত্যক্ষ সমর্থন। মূলত সর্দার প্যাটেলের সৌজন্যেই আজ আধুনিক ভারতের মানচিত্র তৈরি সম্ভব হয়েছে।
যে কথা বলছিলাম, ভি পি মেনন ও সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের দৌত্ম্যে, নরম-গরমে, অনুরোধ-উপদেশে অধিকাংশ প্রিন্সলি স্টেটই ভারতের সঙ্গে জুড়তে রাজি হয়। ভবিষ্যতের কথা ভেবে, সর্দার প্যাটেল প্রিন্সলি স্টেটের শাসকদের দিয়ে Instrument of Accession-এ স্বাক্ষর করিয়ে নেন। যেখানে বলা হয়, প্রতিরক্ষা, বিদেশনীতির মতো বিষয় থাকবে কেন্দ্রের হাতে। আর রাজ্যের অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থা থাকবে রাজ্যের শাসকের হাতে। আজও ভারতে এমনটাই চলে আসছে প্রায়। কিন্তু যত সহজে এই ইতিহাস আজ ঘুরে দেখছি, সেদিন বাস্তবে কাজটা তত সহজ ছিল না। কারণ, হায়দ্রাবাদ, জুনাগড়, কাশ্মীরের মতো রাজ্য ভারতের সঙ্গে জুড়তে বেঁকে বসে। এখানেও মুশকিল আসানে প্রধান ভূমিকা নেন সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল।
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল
১৯৪৮-এ সেনাবাহিনীর সাহায্যে ‘অপারেশন পোলো’-র মাধ্যমে হায়দ্রাবাদকে ভারতের সঙ্গে জুড়ে নেওয়া হয়। জুনাগড় যুক্ত হয় গণভোটের মাধ্যমে। ১৯৪৯-এর মধ্যে প্রায় সব প্রিন্সলি স্টেটই ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়, কিন্তু গলার কাঁটা হয়ে রয়ে যায় কাশ্মীর। সেই থেকেই শুরু কাশ্মীর সমস্বি৮-এ সেনাবাহিনীর সাহায্যে ‘অপারেশন পোলো’-র মাধ্যমে হায়দ্রাবাদকে ভারতের সঙ্গে জুড়ে নেওয়া হয়। জুনাগড় যুক্ত হয় গণভোটের মাধ্যমে। ১৯৪৯-এর মধ্যে প্রায় সব প্রিন্সলি স্টেটই ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়, কিন্তু গলার কাঁটা হয়ে রয়ে যায় কাশ্মীর। সেই থেকেই শুরু কাশ্মীর সমস্যার।
কাশ্মীরের বাসিন্দারা বেশিরভাগই ছিলেন মুসলিম, কিন্তু কাশ্মীরের শাসক ছিলেন একজন হিন্দু– মহারাজা হরি সিং। তিনি প্রাথমিকভাবে কাশ্মীরকে স্বাধীন রাজ্য হিসাবেই রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর একার পক্ষে এই কাজ সহজ ছিল না। কারণ, মুসলিম অধ্যুষিত একটি রাজ্যের শাসক একজন হিন্দু হওয়ায় রাজ্য চালানো তাঁর পক্ষে সহজ ছিল না। কাশ্মীর প্রভিন্সের উপত্যকা ও মুজফ্ফরবাদ জেলায় ৯০% বাসিন্দাই মুসলিম। অন্যদিকে, জম্মু প্রভিন্সের পাঁচ জেলার মধ্যে পূর্বের উধমপুর, জম্মু ও রিয়াসিতে হিন্দু ও মুসলিম জনসংখ্যা ছিল প্রায় সমান সমান। কিন্তু পশ্চিমের মীরপুর ও পুঞ্চ ছিল মুসলিম অধ্যুষিত। লাদাখ জেলায় ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রাধান্য, বাল্টিস্তানে মুসলিমদের।
পরিস্থিতির আরও অবনতি হয় ৪৭-এর অক্টোবরে, যখন নয়া পড়শি মুলুক পাকিস্তানের পশতুন উপজাতির হামলাকারীরা কাশ্মীর আক্রমণ করে বসে ও আধিপত্য স্থাপন করতে চায়। এই কাজে পাকিস্তানের বেশ কয়েকজন সেনা অফিসাররাও যুক্ত ছিল বলে অভিযোগ। পাক সেনাকর্তাদের আশঙ্কা ছিল, অবিলম্বে কাশ্মীরের দখল না নিলে হয়তো ভবিষ্যতে রাজ্যটি ভারতের সঙ্গে জুড়তে চাইবে। সব দেখেশুনে হরি সিং প্রমাদ গুনলেন। তিনি অবিলম্বে Instrument of Accession-এ স্বাক্ষর করতে রাজি হন। বিনিময়ে ভারতের কাছ থেকে সেনা সাহায্য চান। ২৬ অক্টোবর মহারাজা হরি সিং ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতে আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর করেন এবং ভারতীয় সেনাও পাক সমর্থিত হানাদারদের পিছু হটতে বাধ্য করে। সেই সময় শ্রীনগরে সেনাকে দ্রুত পৌঁছে দিতে তাঁদের এয়ারলিফট করা হয়।
কাশ্মীর আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের সঙ্গে জুড়ে যাওয়ায় পাকিস্তান বেজায় চটে যায়। ছলচাতুরি করে নানাভাবে কাশ্মীর দখল করতে চায় করাচি। আওয়াজ তুলতে থাকে, কাশ্মীরের মুসলিমরা নাকি মোটেও ভারতের সঙ্গে থাকতে চায় না। দ্রুতই সেই চোরাগোপ্তা হামলা বদলে যায় পুরোদস্তুর সেনা আগ্রাসনে। আদিবাসী লস্কর জঙ্গিদের সঙ্গে পাক সেনাও কাশ্মীর সীমান্তে অনুপ্রবেশ করতে চায় নানাভাবে। ফলস্বরূপ, প্রথম ইন্দো-পাক যুদ্ধ (১৯৪৭-৪৮), যাকে কাশ্মীর যুদ্ধও বলা হয়। ১৯৪৮-এর মে-তে পাক সেনা জম্মু আক্রমণ করে বসে ও মূল ভারতীয় ভূখণ্ডের সঙ্গে রাজ্যটির সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে চায়। রক্তক্ষয়ী সেই সংঘর্ষে ভারতের অন্তত ১১০৪ জন সেনা শহীদ হন, আহত হন আরও ৩১৫৪ জন। কিন্তু পরাক্রমী ভারতীয় জওয়ানরা সেদিন পাক সেনার জবরদখল থেকে দুই তৃতীয়াংশ জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখকে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
অন্যদিকে, পাক সেনা তাদের দখলে রাখে গিলগিট-বাল্টিস্তানকে। যুদ্ধে পাকিস্তানেরও প্রায় ৬০০০ সেনা মারা যায়। যুদ্ধ চলাকালীন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহেরু উপত্যকায় আরও সেনা, অস্ত্রশস্ত্র না পাঠিয়ে হঠাৎ রাষ্ট্রসংঘের দ্বারস্থ হন এবং মধ্যস্থতার দাবি করে বসেন। এখানেই শুরু বিতর্ক। ঐতিহাসিকদের একটা বড় অংশই এই সিদ্ধান্তের জন্য নেহেরুর সমালোচনা করেন। তাঁদের বক্তব্য, হয়তো নেহেরু যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও আন্তর্জাতিক মহলকে এই বার্তায় দিতে চেয়েছিলেন যে ভারত বরাবর শান্তির পক্ষে। কিন্তু রাষ্ট্রসংঘের দ্বারস্থ হয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে তিনি আন্তর্জাতিক দরবারের মাঝে নিয়ে গিয়ে ফেলেন। এবং পাকিস্তান তারপর থেকে আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রসংঘের হস্তক্ষেপকেই ঢাল করে আসছে। ১৯৪৯-এর পয়লা জানুয়ারি রাষ্ট্রসংঘের দৌত্ম্যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় লাইন অফ কন্ট্রোল(LoC)। এই লাইন অফ কন্ট্রোলই কাশ্মীরকে দুই ভাগে বিভক্ত করে। একদিকে ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর (J&K), অন্যদিকে পাক অধিকৃত কাশ্মীর (PoK)। কাশ্মীর কার সঙ্গে থাকতে চায় তা জানতে রাষ্ট্রসংঘ গণভোটেরও প্রস্তাব দেয় কিন্তু তা আজ অপর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৫৪ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত, কাশ্মীরের স্পেশাল স্টেটাস প্রত্যাহারের আগে পর্যন্ত ভারতীয় সংবিধানের আর্টিকল ৩৭০ মোতাবেক কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হত। কাশ্মীরের জন্য ছিল আলাদা আইন, সম্পত্তির মালিকানার সংক্রান্ত আলাদা নিয়ম।
ভারত একাধিকবার স্পষ্ট করেছে, কাশ্মীরের ভারতে আনুষ্ঠানিক অন্তর্ভুক্তিই চূড়ান্ত। কিন্তু পাকিস্তান সে কথা মানতে নারাজ। তাঁদের দাবি, দমনপীড়ন চালিয়ে কাশ্মীর দখল করে রেখেছে ভারত। আসলে কাশ্মীরের মুসলিমরা পাকিস্তানের সঙ্গেই থাকতে চায়। ইসলামাবাদ বরাবর ঢাল করে এসেছে রাষ্ট্রসংঘের তোলা গণভোটের যুক্তিকে। নির্লজ্জ পাকিস্তনে ১৯৬৫, ১৯৭১, ১৯৯৯-তেও কাশ্মীরে হামলা চালিয়ে দখলের চেষ্টা চালিয়েছে কিন্তু একবারও সফল হয়নি। সামনাসামনি না পেরে, আজ লুকিয়ে, চোরাগোপ্তা পাক রেঞ্জার্সরা লস্কর, জৈশ জঙ্গিদের দিয়ে কাশ্মীরে হামলা চালায়। যার সাম্প্রতিকতম নজির, পহলগামে ২৬ জন নিরাপরাধ ভারতীয় মৃত্যু। এই গণহত্যা ভারতের বুকে আবার PoK পুনর্দখলের দাবি তুলে দিয়েছে।