ভারতে সাত প্রকল্প থেকে আয় কমপক্ষে ১৭৫ কোটি, ‘মৃত অর্থনীতি’র দেশে ‘প্রোমোটারি’ ব্যবসায় লাল হচ্ছেন ট্রাম্প!
ভারতকে ‘মৃত অর্থনীতি’র দেশ বলে ইতিমধ্যেই বিষোদ্গার করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। অথচ এ দেশে চুটিয়ে ব্যবসা করছে তাঁর পরিবার নিয়ন্ত্রিত রিয়েল এস্টেট সংস্থা। এই ‘দ্বিচারিতা’ প্রকাশ্যে আসায় অস্বস্তি বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্টের।

ট্রাম্পের মূল ব্যবসা রিয়েল এস্টেটের। ২০১২ সালে এ দেশে পা রাখে তাঁর পরিবার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা ‘ট্রাম্প অর্গানাইজ়েশন’। সূত্রের খবর, গত বছর পর্যন্ত কোম্পানিটি বেশ কয়েকটি ভারতীয় রিয়েল এস্টেট সংস্থার সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুম্বই, পুণে, কলকাতা ও গুরুগ্রামের সাতটি প্রকল্প থেকে আয় করেছে কমপক্ষে ১৭৫ কোটি টাকা। শুধু তা-ই নয়, গত ১৩ বছরে এ দেশে ব্র্যান্ডটির উপস্থিতি প্রায় চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় বারের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন ট্রাম্প। পরবর্তী আট মাসে এ দেশে ব্যবসা সম্প্রসারণের মরিয়া চেষ্টা করেছে তাঁর পরিবার নিয়ন্ত্রিত রিয়েল এস্টেট সংস্থা। ব্রোকারেজ় ফার্মগুলির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৫ নভেম্বর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে তিনি নির্বাচিত হওয়া ইস্তক ‘ট্রাম্প অর্গানাইজ়েশন’ তার ভারতীয় অংশীদার ‘ট্রিবেকা ডেভেলপার্স’-এর সঙ্গে গুরুগ্রাম, পুণে, হায়দরাবাদ, মুম্বই, নয়ডা এবং বেঙ্গালুরুতে কমপক্ষে ছ’টি প্রকল্পের ঘোষণা করেছে।
সূত্রের খবর, সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলিতে ৮০ লক্ষ বর্গফুট রিয়েল এস্টেট পরিকাঠামো গড়ে তুলবে ‘ট্রাম্প অর্গানাইজ়েশন’। সেই অনুযায়ী লগ্নি করছে তারা। এখান থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের পারিবারিক সংস্থাটি কত টাকা আয় করবে, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। তবে আর্থিক বিশেষজ্ঞদের দাবি, সেই অঙ্ক নেহাত ছোট হবে না। কারণ, এ দেশের বৃহত্তম রিয়েল এস্টেট সংস্থার সঙ্গে অংশীদারিত্ব রয়েছে তাদের। তা ছাড়া বিশ্বের দ্রুততম বৃদ্ধি পাওয়া অর্থনীতির দেশটির সবচেয়ে লাভজনক বাজারে পা রাখেছে ‘ট্রাম্প অর্গানাইজ়েশন’।
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ আবার মনে করেন, ট্রাম্পের সংস্থা ভারতের এমন একটি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেছে, যেখানে ঝুঁকি প্রায় নেই বললেই চলে। উল্টে রিয়েল এস্টেট ক্ষেত্র থেকে ক্রমাগত আয় করতে পারবে তারা। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে সংস্থার রাজস্ব। এ বছর পুণে, গুরুগ্রাম এবং হায়দরাবাদের প্রকল্পের কাজ ইতিমধ্যেই শুরু করেছে ‘ট্রাম্প অর্গানাইজ়েশন’।
এর ফলে প্রায় ৪৩ লক্ষ বর্গফুট রিয়েল এস্টেট পরিকাঠামো তৈরি হবে বলে জানা গিয়েছে।উল্লেখ্য, গত বছর পর্যন্ত এ দেশে ৩০ লক্ষ বর্গফুট পর্যন্ত রিয়েল এস্টেট পরিকাঠামো তৈরি করতে সক্ষম হয় ট্রাম্পের পারিবারিক সংস্থা। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলির কাজ শেষ হলে সেটা ১ কোটি ১০ লক্ষ বর্গ ফুটে পৌঁছোবে বলে আশা করা হচ্ছে। ভারতে ট্রাম্প-ব্র্যান্ডের সংস্থাগুলির পরিচালন সংস্থার নাম ‘টাইব্রেকার’। তারা জানিয়েছে, নতুন প্রকল্পগুলির ফ্ল্যাট বা ফ্লোর বিক্রি করে কমপক্ষে ১৫ হাজার কোটি টাকা ঘরে তুলতে পারবে ‘ট্রাম্প অর্গানাইজ়েশন’।
ট্রাম্পের পারিবারিক সংস্থাটি সরাসরি এ দেশের রিয়েল এস্টেট প্রকল্পে লগ্নি করছে এমনটা নয়। তাদের ব্যবসার মূল ভিত্তি হল ব্র্যান্ড লাইসেন্সিং মডেল। এর মাধ্যমে ভারতীয় রিয়েল এস্টেট সংস্থাগুলিকে ট্রাম্পের নাম ব্যবহারের অনুমতি দিচ্ছে তারা। বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলিকে ‘ট্রাম্প অর্গানাইজ়েশন’-কে দিতে হচ্ছে মোটা টাকা। এ ভাবে ঝুঁকি এড়িয়ে এ দেশে দিব্যি ব্যবসা করছে তারা।
‘ট্রাম্প অর্গানাইজ়েশন’-এর সঙ্গে হাত মিলিয়ে এ দেশের কোনও সংস্থা রিয়েল এস্টেট প্রকল্পের কাজ শেষ করলে বিলাসবহুল সম্পত্তিটি বিক্রিতে মার্কিন কোম্পানিটির থাকছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বিশেষজ্ঞদের দাবি, আর্থিক ঝুঁকি এড়াতে এই পন্থা অবলম্বন করেছে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পরিবারিক সংস্থাটির প্রধান অংশীদার কল্পেশ মেহতার ‘ট্রিবেকা ডেভেলপার্স’ আবার দ্রুত প্রকল্পের কাজ শেষ করতে লোধা গ্রুপ, পঞ্চশীল রিয়েলটি, এম৩এম গ্রুপ এবং ইউনিমার্কের মতো বেশ কয়েকটি বড় রিয়েল এস্টেট সংস্থার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।
এ বছরের অগস্ট পর্যন্ত মুম্বই, পুণে, গুরুগ্রাম ও কলকাতায় চারটি গগনচুম্বী অট্টালিকার (পড়ুন ট্রাম্প টাওয়ার) কাজ শেষ করেছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের পারিবারিক রিয়েল এস্টেট সংস্থা। মোট ৩৫ লক্ষ বর্গ ফুট জুড়ে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলি গড়ে উঠেছে বলে জানা গিয়েছে। এগুলির থেকে ‘ট্রাম্প অর্গানাইজ়েশন’-এর কয়েক কোটি ডলার পর্যন্ত লাভ হতে পারে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
এ দেশে মোট ১০টি ট্রাম্প টাওয়ার তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের পারিবারিক রিয়েল এস্টেট সংস্থার। নতুন প্রকল্পগুলি শুধুমাত্র বসবাসের জন্য তৈরি করতে চাইছে না তারা। উল্টে সংশ্লিষ্ট ট্রাম্প টাওয়ারগুলিতে থাকবে বাণিজ্যিক এবং বিনোদনমূলক জায়গা। নতুন প্রকল্পগুলির মধ্যে প্রথমেই আসবে পুণের ‘ট্রাম্প ওয়ার্ল্ড সেন্টার’-এর নাম। এটি মহারাষ্ট্রের শহরটির কোরেগাঁও পার্কে তৈরি হচ্ছে।
২৭ তলার ‘ট্রাম্প ওয়ার্ল্ড সেন্টার’-এর পুরোটাই কাচের হবে বলে জানা গিয়েছে। মোট ১৬ লক্ষ বর্গ ফুট এলাকা জুড়ে গড়ে উঠবে ওই গগনচুম্বী অট্টালিকা। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে পাশাপাশি দু’টি টাওয়ার তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। সেখানে থাকবে একটি বিলাসবহুল শপিং মল এবং দেশের প্রথম ‘ট্রাম্প ক্লাব’। ব্যবসায়িক নেটওয়ার্কের গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসাবে ব্যবহার হবে ওই এলাকা। ‘ট্রাম্প ওয়ার্ল্ড সেন্টার’ থেকে সব মিলিয়ে ২,৫০০ কোটি টাকা আয় হতে পারে বলে জানিয়েছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
এ ছাড়া এ দেশে গল্ফের মাঠ এবং বিলাসবহুল ভিলা তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের পারিবারিক রিয়েল এস্টেট সংস্থা। তবে এর সঠিক অবস্থান এখনও প্রকাশ করেনি তারা। ছ’টি নতুন প্রকল্পের প্রতিটির ক্ষেত্রে কিছু চমক থাকবে বলে ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করেছে তারা। এগুলির নকশা তৈরি থেকে শুরু করে নির্মাণকাজ এবং পরিশেষে বিক্রি, সবটাই একটা জায়গা থেকে পরিচালিত হবে বলে জানা গিয়েছে।
গত ৩০ জুলাই নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ নয়াদিল্লি ও মস্কোকে নিশানা করে একটি পোস্ট করেন ট্রাম্প। সেখানে তিনি লেখেন, ‘‘ভারত রাশিয়ার সঙ্গে কী করছে, তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। ওরা ওদের ‘মৃত অর্থনীতি’কে একসঙ্গে ধ্বংস করতে পারে। আমি সব কিছুর জন্য চিন্তা করি। আমরা ভারতের সঙ্গে খুব কম ব্যবসা করেছি। কারণ, নয়াদিল্লির শুল্ক অনেক বেশি। একে বিশ্বের সর্বোচ্চ বলা যেতে পারে। রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে প্রায় কোনও ব্যবসা নেই বললেই চলে।’’ তাঁর এই পোস্টের পরেই শুরু হয় হইচই।
উল্লেখ্য, কোনও দেশের অর্থনীতির গতি পুরোপুরি থেমে গেলে, বিশেষজ্ঞেরা তাকে ‘মৃত’ বলে উল্লেখ করে থাকেন। তাঁদের যুক্তি, নানা কারণে এটা হতে পারে। মূলত যুদ্ধ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা মহামারির কারণে অনেক সময় পুরোপুরি থমকে যায় অর্থনীতির চাকা। এ ছাড়া দেউলিয়া রাষ্ট্রের পক্ষেও অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। এই ধরনের দেশই ‘মৃত অর্থনীতি’র তালিকায় পড়বে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকেরা।
ভারতের অবস্থা কিন্তু একেবারেই সে রকম নয়। উল্লেখ্য, মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্টস) সূচকের উপর নির্ভর করে কোনও দেশের অর্থনীতি কতটা ভাল বা খারাপ, তা পরিমাপ করা হয়। সে দিক থেকে বিশ্বের প্রথম পাঁচে নাম রয়েছে নয়াদিল্লির। এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলির তালিকায় দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে ভারত। এক নম্বরে রয়েছে চিন। সূচকের এ-হেন ঊর্ধ্বমুখী অবস্থা ‘মৃত অর্থনীতি’র লক্ষণ নয়, বলছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
চলতি বছরে জিডিপি নমিনালের নিরিখে বিশ্বের ৩০টি বৃহত্তম অর্থনীতির দেশগুলির তালিকায় পাঁচ নম্বরে রয়েছে ভারত। নয়াদিল্লির সামনে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), চিন, জাপান এবং জার্মানি। এর মধ্যে ইইউ আবার ইউরোপের ২৭টি দেশের সংগঠন, যার মধ্যে রয়েছে ফ্রান্স, ইটালি, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডসের মতো দেশ। অন্য দিকে জিডিপি পিপিপির (পারচেজ়িং পাওয়ার প্যারিটি) দিক থেকে ওই তালিকায় তৃতীয় স্থান পেয়েছে ভারত।
মুদ্রাস্ফীতিকে হিসাবে না রেখে একটি নির্দিষ্ট সময়ের নিরিখে কোনও দেশের মধ্যে উৎপাদিত পণ্যের মোট মূল্যের সূচক হল জিডিপি নমিনাল। অন্য দিকে, কোনও রাষ্ট্রের পণ্য ক্রয়ের ক্ষমতাকে মাপা হয় জিডিপি পিপিপির মাধ্যমে। দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে প্রথম স্থানে রয়েছে চিন এবং যুগ্ম ভাবে দ্বিতীয় আমেরিকা ও ইইউ। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, জিডিপি নমিনালের দিক থেকে গত শতাব্দীর ’৮০-র দশক পর্যন্ত ভারতের অর্থনীতি ছিল অনেকটাই ‘মৃতবৎ’। ওই সময়ে সূচকের বৃদ্ধি প্রায় হত না বললেই চলে।
১৯৯১ সালে দেশে আর্থিক উদারনীতির প্রবর্তন করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। ওই সময়ে অবশ্য কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বভার সামলাচ্ছিলেন তিনি। তাঁর নেওয়া পদক্ষেপে সারা বিশ্বের সামনে উন্মুক্ত হয় এ দেশের বাজার। ফলে মাত্র চার বছরের মধ্যে জিডিপি নমিনালের নিরিখে বিশ্বের শক্তিশালী অর্থনৈতিক দেশগুলির তালিকায় ১৭ নম্বর স্থানে উঠে আসে ভারত। ২০০৫ সালে আরও চার ধাপ লাফিয়ে নয়াদিল্লি পৌঁছোয় ১৩ নম্বরে।
তবে আর্থিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এ দেশের অর্থনীতিতে সত্যিকারের গতি আসে ২০১০ সালে। সে বছর প্রথম ১০-এ ঠাঁই পায় ভারত। পরবর্তী পাঁচ বছর দশম স্থান ধরে রাখে নয়াদিল্লি। এই সময়সীমাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন তাঁরা। কারণ, এর পর আর সরকারকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০২০ সালে কোভিড অতিমারি থাকা সত্ত্বেও জিডিপি নমিনালের তালিকায় সাত নম্বরে ঠাঁই পায় ভারত। এ বছর সেখান থেকে আরও দু’ধাপ উপরে উঠেছে সূচক।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, দেশের আর্থিক বৃদ্ধির এই গতি বজায় থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশে (অর্থনীতির দিক থেকে) পরিণত হবে ভারত। এ দেশের বৃদ্ধির সূচক নিয়ে চাঞ্চল্যকর পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার বা আইএমএফ (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড) এবং বিশ্ব ব্যাঙ্ক। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, চলতি আর্থিক বছর (পড়ুন ২০২৫-’২৬) শেষ হতে হতে তালিকায় চার নম্বর স্থানে পৌঁছে যাবে নয়াদিল্লি।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, ভারতের অর্থনীতি যে ‘মৃত’ নয় তা ভালই জানেন ট্রাম্প। সেই কারণে এ দেশের বাজারে ঢালাও ব্যবসা করছে তাঁর সংস্থা।
Tags
#Modi vs Trump